বুধবার । ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২০শে কার্তিক, ১৪৩২
ডুমুরিয়ায় অপব্যয়িত সম্পদে পরিণত হয়েছে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প!

টোকা দিলে ভেঙে পড়ছে প্লাস্টার, ফেটে গেছে ঘরের পিলার

সুব্রত কুমার ফৌজদার, ডুমুরিয়া

ডুমুরিয়ায় অপব্যয়িত সম্পদে পরিণত হয়েছে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প! একদিকে পানি, অন্যদিকে ভাঙাচোরা ঘর। নির্মাণের তিন বছরের মধ্যে ধসে গেছে ফ্লোর। টোকা দিলে ভেঙে পড়ছে প্লাস্টার, ফেটে গেছে ঘরের পিলার ও টয়লেটের দেয়াল। সরকারি কর্মকর্তাদের চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ঘর পেয়েও গৃহহীন রয়েছেন প্রকল্পের অধিকাংশ সুফলভোগীরা।

জানা যায়, ২০২১-২২ ও ২০২৩ অর্থ বছরে চার ধাপে ডুমুরিয়া উপজেলায় গৃহহীন এবং বাস্তুচ্যুত এক হাজার একশ’ ৫৫ পরিবারের মাঝে জমিসহ ঘর হস্তান্তর করে আওয়ামী লীগ সরকার। ঘরগুলো নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২১ কোটি ৮৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। প্রতি ঘরের অনুকূলে দেওয়া হয়েছে ২ শতাংশ জমি। সবমিলে উপজেলায় মোট ২৩.১ একর সম্পত্তির উপর ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়। এসব ঘর নির্মাণ থেকে শুরু করে দলিল হস্তান্তর পর্যন্ত ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

সরকারের কাছ থেকে পুরস্কৃত হওয়ার আশায় তখন ডুমুরিয়ায় দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘর নির্মাণ শেষ করার পরিকল্পনা নেয় উপজেলা প্রশাসন! উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন প্রকল্পের একক তত্ত্বাবধায়ক। ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নের সাজিয়াড়া শেয়ারঘাটা আবাসন প্রকল্পের ঘর নির্মাণের তিন বছর পার না হতেই ধসে গেছে ফ্লোর। একটি ঘরের দেয়ালের সাথে অন্য ঘরের দেয়াল সংযুক্ত করা হয়েছে। যা সিডিউলে উল্লেখ রয়েছে প্রতিটি ঘরের দূরত্ব কমপক্ষে ৬ ফুট থাকতে হবে। অনিয়মের এখানেই শেষ নয়। ঘরের নষ্ট হয়ে গেছে জানালা-দরজা। টিনের জোড়া দিয়ে ঘরের ভিতরে পড়ে বৃষ্টির পানি।

১৮ নম্বর ঘরের বাসিন্দা শাহনারা খাতুন জানান, “ঘর নির্মাণের প্রথম বছরেই ফ্লোর ধসে যায়। কিছুদিন পর দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। এখন আর ঘরে বসবাস করার উপায় নেই। একদিকে ভাঙা ঘর, অন্যদিকে কোমর পানিতে ডুবে রয়েছে ৫ মাস যাবৎ।”

১১ নম্বর ঘরের বাসিন্দা তুজাম্মেল মোল্যা জানান, “ঘর ভেঙে চুরে পড়েছে। তাছাড়া ঘরগুলো উচ্চতা অনেক কম করেছে। যার কারণে বৃষ্টির মৌসুম থেকে শুরু করে শীতের অর্ধেক পর্যন্ত আমাদের পানির সাথে বসবাস করতে হয়।”

২০ নম্বর ঘরের বাসিন্দা পারভীন বেগম বলেন, “ঘরের যা অবস্থা টোকা দিলি প্লাস্টার খসে পড়ছে। একটা টিউবওয়েল আছে কিন্তু সেটি দিয়ে ঘোলা পানি ওঠে। বাইরে থেকে আমাদের খাবার পানি আনতে হয়। আমরা ত্রাণ চাচ্ছি না, সরকার আমাদের ঘরগুলো অন্তত উঁচু করে দিক।”

বর্তমানে এ আবাসনের ঘর ছেড়ে ৩০টি পরিবার অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়ার কথা থাকলেও অনেক সচ্ছল ব্যক্তিদের নামেও ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত গৃহহীন পরিবার আড়ালে পড়ে যায়। যার কারণে অনেকে ঘর দখলে রেখে অন্যত্র বসবাস করছে।

ভূমি অফিস সূত্রে জানা জানায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ৪টি ধাপে উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নে ৩৮টি, রঘুনাথপুরে ৭টি, রুদাঘরায় ১০৮টি, খর্ডুয়ায় ৩২টি, আটলিয়ায় ৩১২টি, শোভনায় ৩২৫টি, সাহসে ৫টি, ভান্ডারপাড়ায় ১৫৭টি, ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নে ৮৯টি এবং রংপুর ইউনিয়নে ৮২টি ঘর নির্মাণ করা হয়। মোট এক হাজার একশ’ ৫৫টি ঘরের মধ্যে ৮৮০টি ঘরে দলিল হস্তান্তর করা হয়। এসব ঘরের মধ্যে অধিকাংশ ঘর ভেঙে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অতি নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে এসব ঘর করার অভিযোগ সচেতন এলাকাবাসীর।

আটলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখ হেলাল উদ্দিন জানান, “ঘর ভেঙে পড়াসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র নষ্ট হওয়ার খবর একের পর এক শুনতে হচ্ছে। তখন ঘরগুলো সম্পূর্ণ ইউএনও’র তত্ত্বাবধায়নে নির্মাণ হয়েছে। সেখানে কোনো ইউপি চেয়ারম্যান বা মেম্বারদের কাউকে সম্পৃক্ত করেনি।”

অতি নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা করায় নির্মাণের ২/৩ বছর পার না হতেই ভেঙে পড়ছে। তিনি বলেন, “চুকনগর ও কাঠালতলা এলাকায় ভদ্রা নদীর চর ভরাটি জায়গায় আবাসন করা হয়েছে। সম্প্রতি নদী খননের সীমানায় অধিকাংশ ঘর পড়ে গেছে। ফলে এসব ঘর উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একদিকে যেমন টেকসই ভাবে ঘর নির্মাণ না হওয়া অন্যদিকে নদী খননের ফলে উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে শতাধিক গৃহ। ফলে অপব্যয়িত সম্পদে পরিণত হয়েছে সরকারের এই আশ্রয়ণ প্রকল্প।”

এ বিষয়ে খুলনা জেলা প্রশাসক মোঃ তৌফিকুর রহমান বলেন, “ডুমুরিয়ায় আবাসন প্রকল্পের বিষয়ে আমার নলেজে নেই। তবে বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো ঘর নির্মাণে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি রয়েছে কিনা। অনিয়মের সত্যতা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন